বাংলাদেশে ইটভাটা শিল্প দেশের নির্মাণ খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইটভাটার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, এবং অন্যান্য দূষণকারী পদার্থ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
১. বায়ু দূষণ
ইটভাটার প্রধান সমস্যা হলো বায়ু দূষণ। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ইটভাটা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার না করে ইট তৈরি করে। ইট পোড়ানোর জন্য কয়লা, কাঠ, এবং জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে বাতাসের মানের ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটার কার্যক্রম তীব্র হয়ে উঠলে বায়ু দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।
২. জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
ইটভাটা থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে। কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে, ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আরও তীব্র হচ্ছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে উঠেছে, যা ইটভাটার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির ফলে আরও খারাপ হচ্ছে।
৩. মাটি ক্ষয় ও ভূমির উর্বরতা হ্রাস
ইট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হলো মাটি। বাংলাদেশে ইট তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণে টপ সয়েল (মাটির ওপরের স্তর) সংগ্রহ করা হয়, যা মূলত কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টপ সয়েল অপসারণের ফলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ফসল উৎপাদন কমে যায়। এছাড়াও, মাটি সংগ্রহের ফলে ভূমিক্ষয় ঘটে, যা প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।
৪. বন উজাড় ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস
ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে অনেক সময় কাঠ ব্যবহার করা হয়, যার ফলে বনাঞ্চল ধ্বংস হয় এবং জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। বন উজাড় হলে আবাসস্থল হারায় বন্যপ্রাণীরা এবং গাছপালা ধ্বংস হওয়ায় কার্বন শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
৫. জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
ইটভাটার বায়ু দূষণ সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইটভাটার আশেপাশে বসবাসকারী মানুষেরা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া, দূষিত বায়ু ত্বক এবং চোখের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে।
৬. পানি দূষণ
ইটভাটার কার্যক্রমের কারণে আশেপাশের জলাশয়গুলো দূষণের শিকার হয়। ইট তৈরির সময় ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ এবং বর্জ্য পানি দূষণ করে, যা জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পানির মানের অবনতি হলে সেই এলাকার মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভোগে এবং জলজ প্রাণীরা বিপন্ন হয়।
সমাধান ও করণীয়
বাংলাদেশে ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব কমাতে কিছু কার্যকর সমাধান গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার
ইটভাটায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। জিগজ্যাগ বা হাইব্রিড হফম্যান কিল্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কয়লার ব্যবহার কমে এবং কম কার্বন নির্গমন হয়।
২. বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী
ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক, কংক্রিট, বা পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব উপকরণ পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী।
৩. কঠোর আইন প্রয়োগ
ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। পরিবেশ আইন অনুযায়ী ইটভাটার অবস্থান, জ্বালানি ব্যবহার, এবং নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশে ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই প্রভাব কমানো সম্ভব। ইটভাটার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দেশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে।